সংকট মোকাবিলায় পেঁয়াজের গুঁড়া উদ্ভাবন করেছেন বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। হলুদ, মরিচ বা ধনিয়ার গুঁড়ার মতোই রান্নার কাজে এখন থেকে ব্যবহার করা যাবে এই গুঁড়া। বিষয়টি শুনতে অবাক লাগলেও অস্বাভাবিক নয়; বরং কাঁচার চেয়ে পেঁয়াজের গুঁড়া বেশি সাশ্রয়ী হবে এবং সংরক্ষণ করা যাবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা আরও বলেছেন, এ প্রক্রিয়ায় দেশের মোট চাহিদার ৩০ শতাংশ পেঁয়াজের পচন রোধ করা সম্ভব হবে। তাছাড়া দেশে পেঁয়াজ আমদানির ওপর চাপ কমবে।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা পেঁয়াজ সংকট মোকাবিলায় নতুন এই উপায় উদ্ভাবন করেছেন। পেঁয়াজ প্রক্রিয়া ও প্যাকেটজাত করে সংরক্ষণের মাধ্যমে কাঁচা পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে গুঁড়া পেঁয়াজ ব্যবহারের দেশীয় পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন তারা। সাধারণভাবে ঘরেই গুঁড়া পেঁয়াজ সংরক্ষণ করা সম্ভব। এরইমধ্যে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রে দেশীয় পদ্ধতিতে এই গুঁড়া পেঁয়াজ পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করা হয়েছে। মসলা গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৫ লাখ টন। দেশীয়ভাবে পেঁয়াজের উৎপাদন হয় ২৩ দশমিক ৭৬ লাখ টন। ১১ থেকে ১২ লাখ টন পেঁয়াজ প্রতিবছর ঘাটতি থাকে, যা আমদানি করা হয়।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মাসুদ আলম জানান, সংরক্ষণের সময় সব ধরনের পেঁয়াজ অন্তত ৩০ ভাগ ঘাটতি বা অপচয় হয়। দেশীয় জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন হেক্টর প্রতি ১০ থেকে ১১ টন হলেও গ্রীষ্মকালীন বারি-৫ জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন হেক্টর প্রতি ২৩ টন পর্যন্ত হয়। তবে কৃষক পর্যায়ে এর উৎপাদন এখনো সীমিত রয়েছে। স্থানীয় জাতের দেশি পেঁয়াজের চেয়ে বারি ২, ৩, ৪, ৫ ও ৬ জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি হলেও নানা কারণে কৃষক পর্যায়ে এর উৎপাদন ছড়ানো যায়নি। এর অন্যতম কারণ এসব পেঁয়াজ সংরক্ষণের সময় ১ থেকে ৩ মাস পর্যন্ত। এজন্য অনেক কৃষকই গ্রীষ্মকালীন বারি জাতের পেঁয়াজে তেমন আগ্রহী নন বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
গবেষক ড. মাসুদ আলম জানান, পেঁয়াজ গুঁড়া করলে এর গুণগত মান, খাদ্যে ব্যবহারের পরিমাণ কোনোটাই কমে না। এক কেজি পেঁয়াজ শুকিয়ে গুঁড়া পাওয়া যায় ১০০-২০০ গ্রাম। রান্না করার ক্ষেত্রেও অনুপাত এভাবে বণ্টন হয়। তার মতে, একটি পরিবারে এক কেজি মাংস রান্না করতে কাঁচা পেঁয়াজ লাগে ২৫০ গ্রাম। আর এই ২৫০ গ্রাম পেঁয়াজ গুঁড়া করলে পাওয়া যাবে ২৫ গ্রাম। মাংস রান্নাতে গুঁড়া পেঁয়াজের ২৫ গ্রামই দিলেই যথেষ্ট হবে।
পেঁয়াজের গুঁড়া উদ্ভাবনের পদ্ধতি প্রয়োগ করলে সংরক্ষণের সময়জনিত আর কোনো সমস্যা থাকবে না। কারণ পেঁয়াজের গুঁড়া অনায়াসে এক বছর প্যাকেটজাত করে সংরক্ষণ করা যায়। এতে বারি জাতের উচ্চ ফলনশীল গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনের পর তা গুঁড়া করে সংরক্ষণ ও ব্যবহার করলে সংরক্ষণ ঘাটতি যেমন থাকবে না, তেমনি কৃষকরা ন্যায্য মূল্যও পাবেন। আর উচ্চ ফলনশীল বারি জাতের পেঁয়াজে কৃষকদের আগ্রহও বেড়ে যাবে।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষণাগারে ড. মাসুদ আলমের তত্ত্বাবধানে গুঁড়া পেঁয়াজের উৎপাদন চলছে। তিনি জানান, জাপান, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বহু দেশে পেঁয়াজের গুঁড়া ব্যবহারের প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে নেই। এ কারণে তিনি প্রায় ৩ বছর ধরে পেঁয়াজের গুঁড়া করে সংরক্ষণের বিষয়ে গবেষণা করেন। তিনি আরও জানান, খুব সাধারণভাবে যে কোনো উদ্যোক্তা ঘরে বসেই এই পেঁয়াজের গুঁড়া উৎপাদন ও সংরক্ষণ করতে পারবেন। এটি ছড়িয়ে দিতে পারলে পেঁয়াজ সংকট আর থাকবে না। এটির পদ্ধতি খুব সাধারণ। খোসা ছাড়িয়ে পেঁয়াজ প্রথমে সøাইস করে ভাঁপ দিতে হবে। পরে তা শুকিয়ে সোডিয়াম মেটাবাইসারফেট দ্রবণে ৪/৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখার পর তা শুকাতে হবে। এরপর সাধারণ ব্লেন্ডিং মেশিনেই এটি গুঁড়া করা যাবে।
ড. মাসুদ জানান, এটি নিশ্চিত এক বছর পর্যন্ত ব্যবহার করার কথা বললেও আসলে এই পেঁয়াজের গুঁড়া ২ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হামীম রেজা বলেন, পেঁয়াজের গুঁড়া পদ্ধতি যুগান্তকারী উদ্ভাবন। এটি যদি বাণিজ্যিকভাবে না করে শুধু ঘরোয়াভাবে করলেও লাভ। তাতেও দেশে পেঁয়াজের আমদানি কমবে। তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে প্রাণ কোম্পানিসহ দেশের কয়েকটি জেলা থেকে একাধিক ব্যক্তি এই উদ্ভাবন দেখে গেছেন। এতে উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বাড়ছে। তবে কেউ ব্যবসা শুরু করতে হলে আমাদের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর চুক্তি (এমওইউ) করতে হবে। এমওইউ থাকলে আমরাও বিভিন্ন সময়ে তাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারব।
Leave a Reply